:: হেলাল হোসেন কবির :: ভারত মুখে যাই বলুক না কেন, তাদের অন্তরে ব্যাথা লুকিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের কারণে ভারতের ৭টি রাজ্য অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও নীতিতে দুর্বল হয়ে আছে। ইতিপূর্বে বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতিতে লুকিয়ে থাকলেও হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ফলে বাংলার সাধারণ জনগণের মুখে মুখে নতুন করে আলোচনায় আসে সেভেন সিস্টার এর নাম। মিডিয়াতে সেভেন সিস্টার আলাদা জায়গা করে নিতে থাকে। বিশ্ব দরবারেও উঁকি দেয় এই আলোচনা। এটাকে ভারত ভালো ভাবে নিচ্ছে না।
শুরু হয় সেভেন সিস্টার এর অভিমুখ শিলিগুড়ি চিকেন নেক এর চিনাশক্তির বলিদান হওয়ায় আশংকা। শিলিগুড়িকে নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় ভারত সরকারের। যার ফলে ভারত সেভেন সিস্টার এর দৃষ্টি ফেরাতে তাত্ক্ষণিক নতুন ফাঁদ পাতেন। তা হলো বাংলাদেশের ফেনি জেলাকে হঠাৎ করে পানি ডুবিয়ে দেয়। তারপর চট্টগ্রামের বেশ কিছু অঞ্চলে বন্যা দেখা গেলো। কিছুদিন এই আলোচনাতে ব্যস্ত রাখতে মূলত ভারতের এই আয়োজন। মানব বন্যা সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে ভিন্ন কিছু ঈঙ্গিত দিলেন। এই বিষয় নিয়ে সামনে আসে মিশ্র আলোচনা। তাহলে কি ভারত বুঝাতে চাচ্ছেন শিলিগুড়ি ১৭কিলোমিটার দূরত্বের কথা চিন্তা না করে বাংলাদেশের ফেনির ২৫কিলোমিটারের কথা ভাবুন। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র পথ হয়ে সেভেন সিস্টারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ত্রিপুরার সাথে সংযোগ সৃষ্টি করতে মাত্র ২৫কিলোমিটার সড়কের দূরত্ব রেখাকে মনে করাতে চায় ভারত। হয়তো বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতি ও দেশ চালিকা শক্তি বুঝতে পারলেও দেশের মানুষ তা বুঝতে পারেনি। তারপর থেকে কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ঢাকা ও দিল্লির নতুন সুর লক্ষ করা যাচ্ছে।
অথচ ছাত্র আন্দোলনের শেষে নতুন সরকারের উপদেষ্টাগণ ভারতবিরোধী সুর মিলিয়ে গদিতে বসতে না বসতে পুরনো পদ্ধতিতে হাটতে শুরু করেন। উপদেষ্টাদের একজন বললেন ভারতকে ইলিশ না দিয়ে দেশের মানুষের চাহিদা মিটানো হবে। নামে মাত্র এমন একটা বার্তা দিয়ে চুপ করে বসে থেকে তলে তলে ইলিশের মজুত করতে শুরু করলেন।
এদিকে সোশাল মিডিয়ায় ভারতের ইলিশ যাচ্ছে না বলে হৈহল্লা শুরু হয়। সোশাল মিডিয়ায় নাচানাচি দেখে অপরদিকে ভারত সুযোগ বুঝে সু-কৌশলে বাংলাদেশের পাহাড়ি আদিবাসীদের উস্কে দিতে থাকে। পাহাড়ি চিত্র ভয়াবহ অবস্থায় পরিণত হয়। তবে, ভারতে ইলিশ যাবে এমন চুক্তি হওয়ায় দিন থেকে পাহাড়ের উত্তাপ কমতে শুরু করে। শেষ মেশ ভারতের মুখ বন্ধ রাখতেই ইলিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে ভিতর থেকে। দেশের মানুষকে আবারও ইলিশ থেকে দুরে সরে রাখা হলো।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের পথ দেখানো রূপরেখা তৈরি করে ইতিমধ্যে সেভেন সিস্টারের এক রাজ্য মনিপুরের আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছেন তাদের মিডিয়াতে, কলকাতা জুড়ে একই বলয়ের মধ্যে আন্দোলন চলছে এবং এই সুযোগে চিনা সৈন্য ভারতের অরুনাচল রাজ্যে ৬০কিলোমিটার জায়গা দখলে নিয়েছে বলে দাবি করছেন। অপরদিকে শেখ হাসিনাকে দেশে জায়গায় দেওয়াতে ভারতের রাজনীতিতে মিশ্র আলোচনা শুরু হয়েছে, বিরোধী দলও সরকার দলের মতো আওয়াজ তুলছেন। সবকিছু মিলে ভারত ক্ষেপে আছে বাংলাদেশের উপর। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বাংলাদেশ নিয়ে বেশ চাবিয়ে চাবিয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ অংশের ৪হাজারের বেশি সীমান্ত জুড়ে বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে আমাদের দেশের বেশ কিছু স্থানে সীমান্ত দখলের চেষ্টা করে বিএসএফ। যে সাহস এতোদিন বিএসএফ দেখায়নি সেই কাজে হাত দিচ্ছেন তারা। তাদের কাঁটাতারের দখলকে বিজিবি ঠেকিয়ে দিচ্ছে।
ভারতীয় মিডিয়াগুলো ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই উস্কানিমূলক ও উদেশ্যমূলক ভাবে বাংলাদেশের বসবাসরত হিন্দু জনগণে আতংকিত করতে বিভিন্ন কথা বলে চলছে এবং মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র ধরে জানা যায়, বাংলাদেশের হিন্দু জনগণ গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি পাসপোর্ট অফিসে ভিড় করছেন, এমনকি পরিবারের সকলের পাসপোর্ট করে রাখছেন, গত কয়েক বছর ধরে এমন চিত্র লক্ষ্য করা যায়নি, গত দুই মাসে পাসপোর্ট অফিসে তাদের ভীড় চোখে পড়ার মতো, যা গত দুই/ তিন বছরের সমান। হঠাৎ করে এমন চিত্র বড় উৎকন্ঠার বিষয়। এর ভিতরে ভারতের নতুন কোন চমক হবে কি’না তা জানিনা।
এখন পাহাড়ি আদিবাসীদের নতুন সুরে কথা চলছে, আসলেই ভারত আমাদের পাহাড়ি কিছু নেতার সাথে যোগসাজশ করে আদিবাসীদের পুতুল বানাতে চায়, পাহাড়িদের রাগান্বিত করে চট্টগ্রামকে আলাদা করা ষড়যন্ত্র করছে। সেভেন সিস্টারকে বাঁচাতে ভিন্ন কৌশলে হাটতে বেড়িয়েছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ঠিক তাদের ২২তম রাজ্য সিকিমকে যেভাবে রাজতন্ত্রের তকমা লাগিয়ে পাতানো ভোটের মাধ্যমে তাদের পক্ষে নিয়েছিলো, সেই পুড়ানো পদ্ধতি নতুন রূপে প্রকাশ করতে চায় চট্টগ্রামে। তারা ফেনির মাটিকে টার্গেট করে আছে এই ভেবে যে, চট্টগ্রামে সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এই ফেনি। দিল্লির সাথে সেভেন সিস্টারের যোগাযোগের মাধ্যম যেমন শিলিগুড়ি যাকে চিকেনস নেক বলা হয় এখন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থারা ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ মুখ ফেনিকে বাংলাদেশের চিকেনস নেকের তকমা লাগিয়ে চট্টগ্রামকে আলাদা করার কৌশল বুনছেন। তাই সেখানে একটা কিছু করতে পারবে বলে তারা চট্টগ্রামকে আলাদা করার মিশনে নেমেছেন। আর ২য় মিশন চালাচ্ছে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন এলাকায়।
বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশ কিছু উপদেষ্টার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ভারত হয়তোবা উপদেষ্টাদের সেই ক্ষমতা রক্ষার বিষয় বুঝাতে তলে তলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই সরকারের শুরু থেকে একের পর এক অস্থিরতা তৈরি করে চলছে। সেই সাথে রাষ্ট্র পরিচালনায় ড. ইউনুসকে ভাবাচ্ছেন। ভারতের বাহিনী দীর্ঘ বছরগুলো ধরে এই দেশের অলিগলি চুষে বেড়িয়েছেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫বছর ভারত বিনা বাঁধায় এক প্রকার দাওয়াতি ভাবেই বাংলাদেশকে ইঁদুরের মতো কেটেছেন। কোন জায়গায় কোন চাবি কাজ করে তার সবকিছু ভারতের নখদর্পনে রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে বিপদ ফেলার প্রথম ধাপ কিন্তু ফেনিতে পানি ঢুকিয়ে জানান দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভারত বাংলাদেশকে এমন ভাবে সংকট সৃষ্টি করতে চায় যাতে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে ভারত ধরা না পড়ে।
বাংলাদেশের জন্য ভারত নিরাপদ নয়, এটা ভেবেই সামনের দিনগুলো আগাতে হবে। নতুন করে অস্থিরতায় মদন দিয়ে যাবে ভারত। পাকিস্তান সীমান্ত, চীন সীমান্ত ও তাদের দেশের ভিতর রাজ্যগুলোতে নিজস্ব অস্থিরতার ফলে ভারত আড়াই ক্ষেত্রে যুদ্ধের হিসাব বাংলাদেশে উপর তুলতে চাচ্ছেন। বাংলার রাজনীতির মেরূকরনে অস্তিত্বের নাগ গলাবেন তারা। এখন চট্টগ্রামে কিছু উগ্রবাদীদের মদদ দিয়ে আদিবাসীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বাংলার পাহাড়া ইঁদুর হয়ে গর্ত খুঁড়ছে ভারত। তাদের ৭টি রাজ্যকে টেক্কার হাত থেকে বাঁচাতেই ফেনি ও চট্টগ্রামকে দরকার। তাই এখানে তারা সরাসরি যুদ্ধ না করে পাহাড়িদের মাঝে যুদ্ধ বাজাতে চাইছেন। অনেকে মনে করছেন ভারত বাংলাদেশের উপর দিয়ে সেভেন সিস্টারকে বাঁচাতে রেলপথ ব্যবহারের শেষ আশাও ভেস্তে গেছে, তাই সমুদ্র পথ দিয়ে ফেনির সড়ক পথে ত্রিপুরা ও মিজোরামের মাধ্যমে বাকি রাজ্যোগুলোর নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে চায়। সর্বশেষ ভারত হয়তো বুঝাতে চায় বাংলাদেশ তুমি আমার সঙ্গে থাকো, তা না হলে অস্থিরতা লেগে থাকবে। সামনে হয়তো নতুন কোন চুক্তির ইঙ্গিত দিবে কি’না সেটাও দেখার বিষয়।
আর তা না হলে হয়তো এর মধ্যে দেশে কোন সংকট সৃষ্টি করে দেশের সরকারকে সেই সংকট মোকাবেলা করার জন্য ব্যস্ত রেখে পাহাড়িদের আলাদা করার কৌশল দেখাবে ভারত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দিকে বাড়তি নজর দেওয়া দরকার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আগের চেয়ে নতুন রূপে আরও কৌশলী ও সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, লালমনিরহাট।